রহস্যে ঘেরা ইস্টার দ্বীপ

প্রকাশঃ অক্টোবর ২৭, ২০১৫ সময়ঃ ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৯:১৮ পূর্বাহ্ণ

প্রতিক্ষণ ডেস্ক

প্রশান্ত মহাসাগরের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ ইস্টর আইল্যান্ড। এর পূর্ব দিকে তেইশশত মাইল দূরে চিলি’র উপকূল আর পশ্চিমে তেরশ মাইল দূরে পলিনেশিয়ো দ্বীপপুঞ্জের পিটকের্য়ান দ্বীপ। ছিষট্টি বর্গমাইলের এই ছোট্ট ত্রিভুজাকৃতির দ্বীপটিতে অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় ইউরোপিয়ো নাবিকরা যখন প্রথম পদার্পণ করল, তখন তারা
বিস্ময়ে দেখতে পেল যে সারা দ্বীপের সমুদ্রতীরের ধার ঘেঁষে শত শত প্রকাণ্ড প্রস্তরমূর্তি কে বা কারা বানিয়ে রেখেছে। মূর্তিগুলো প্রকান্ড–পনেরো/বিশ ফুট থেকে সত্তর ফুট লম্বা (প্রায় ছয়তলা বাড়ির সমান উচু) এবং ওজন দশটন থেকে আড়াইশো টনেরও বেশি।

easter island

“ইস্পাতের মতো কঠিন আগ্নেয় শিলাকে কাটা হয়েছে মাখন-কাটা করে। দশ হাজার টন ওজনের সব পাথর পড়ে আছে এখানে-ওখানে -সেখানে। তাদের আর চাঁছা-ছোলা করা হয়ে ওঠেনি। ৩৩ ফুট থেকে ৬৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা আর প্রায় পঞ্চাশ টন ভারী শত শত মূর্তি আজো চেয়ে থাকে পর্যটকদের মুখের পানে, বুক ফুলিয়ে।”

ইস্টার দ্বীপটির নামকরণ করেন এক ডাচ অভিযাত্রী ১৭২২ সালে। পাঁচই এপ্রিল তারিখে এই দ্বীপটি প্রথম গোচরে আসে এবং ঐদিন ছিল খ্রিস্টানদের পবিত্র ‘ইস্টার দিবস’। তাই দ্বীপটির এই নামকরণ। দ্বীপটির অবস্থান বিষুবীয় অঞ্চলের নিচে ২৭ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ বরাবর।

লক্ষাধিক বছর আগে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ত্রিভুজাকৃতির এ দ্বীপ সৃষ্টি হয়। দ্বীপটির তিন কোণে রয়েছে তিনটি মৃত আগ্নেয়গিরি। এটি লম্বায় ২৪.৬ কিলোমিটার এবং সবচেয়ে প্রশস্ত অংশটির দৈর্ঘ্য ১২.৩ কিলোমিটার। মোট আয়তন ১৬৩.৬ বর্গ কিলোমিটার। সবচেয়ে উঁচু অংশটির উচ্চতা ১৬৬৩ ফুট।

এই দ্বীপটি সারা দুনিয়ায় খ্যাতি লাভ করেছে তার পাথুরে বিশালাকার মূর্তিগুলোর জন্য। মূর্তিগুলোকে ডাকা হয় ‘মোয়াই’ নামে এবং মূর্তিগুলোকে পাথরের তৈরি প্লাটফর্মে দাঁড় করানো হয়েছে, যেগুলোকে ডাকা হয় ‘আহু’ নামে। প্রতিটি আহু এবং মোয়াই’র আবার আলাদা নাম আছে। দ্বীপজুড়ে রয়েছে ৩১৩টি আহু যার মধ্যে ১২৫টিতে মোয়াই স্থাপন করা হয়েছে। দ্বীপের পরিধিজুড়ে প্রতি দেড় কিলোমিটার পরপর রাখা আছে আহু। আহু দ্বারা প্রায় পুরো দ্বীপকেই আবর্তিত করা হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ববিদ ভেন টিলবার্গ ১৯৮৯ সালে দ্বীপজুড়ে এক জরিপ চালান। তার জরিপে দ্বীপটিতে মোট ৮৮৭টি মোয়াই পাওয়া যায়। প্রাপ্ত মোয়াই’র মাঝে ২৮৮টিকে বিভিন্ন স্থানেস্থাপিত আহুতে দাঁড় করানো অবস্থায় দেখা যায়।বেশিরভাগ মোয়াই যে খনি থেকে তৈরি করা হয়েছিল তার নাম ‘রানু রারাকু’। রানু রারাকুতে নির্মিত বা নির্মাণাধীন অবস্থায় পাওয়া যায় ৩৯৭টি মোয়াই। ৯২টি মোয়াই রানু রারাকু থেকে বিভিন্ন আহুতে স্থানান্তরিত করা অবস্থায় রাস্তায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। বাকি আহুগুলো মিউজিয়াম ও দ্বীপের অন্যান্য স্থানে পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ মূর্তিরই মাথা পুরো মূর্তিটির ৫ ভাগের ৩ ভাগ।

সবচেয়ে বড় মোয়াই যা রানো রারাকু কারখানাতেই রয়ে গেছে তার নাম ‘এল জিগান্টি’। এর উচ্চতা ৭১.৯৩ ফুট এবং ওজন আনুমানিক ১৬৫ টন। আহুতে দাঁড় করানো মোয়াই’র মাঝে সবচেয়ে বড়টি হলো ‘পারু’ যার উচ্চতা ৩২.৬৩ ফুট এবং আনুমানিক ওজন ৮২ টন। অবশ্য ‘আহু হাঙ্গা টে তেঙ্গা’তে ৩৩.১০ ফুট উঁচু একটি মোয়াই ইস্টারবাসী নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু দাঁড় করানোর সময় এটি পড়ে যায়। সবচেয়ে ছোট মোয়াইটি আছে ‘পুইক’-এ। এটির উচ্চতা ৩.৭৬ ফুট। গড়পড়তা প্রতিটি মোয়াই’র উচ্চতা ১৩.২৯ ফুট, তলের প্রস্থতা ৫.২৫ ফুট, মাথার প্রস্থতা ৪.৮৬ ফুট, মোয়াই’র মাঝামাঝি স্থানের গভীরতা ৩.০২ ফুট এবং ওজন ১৩.৭৮।

ক্যাপ্টেন রগেভিন ইস্টারে নেমে দ্বীপে স্থাপিত বিশালাকায় পাথুরে মূর্তিগুলো দেখে অবাক হয়ে যান। কারণ তিনি দ্বীপটি প্রায় বৃক্ষশূন্য অবস্থায় দেখতে পান। হাজারদুয়েক রুগ্ন মানুষ আর তাদের তৈরি একদম হালকা ধাঁচের কিছু মাছ ধরার নৌকা দেখেন তিনি। তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না এরকম একটি অনগ্রসর দ্বীপবাসীর পক্ষে পাথর খোদাই করে কী করে এত বিশাল মূর্তি বানানো সম্ভব হয়েছিল। ইস্টারবাসীর ছিল না পাথর কাটার কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি যা দ্বারা তারা এত বিশাল পাথর খোদাই করতে পারবে, ছিল না কোনো আধুনিক যান যা দ্বারা তারা রানু রারাকু কারখানা থেকে মোয়াইগুলো নানা স্থানে স্থাপিত আহুতে নিয়ে যাবে বা ছিল না কোনো ক্রেন যা দ্বারা তারা আহুতে মোয়াই স্থাপন করবে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ চালানোর জন্য যত মানুষ দরকার এবং খাবারের দরকার তা তো ছিল না ইস্টারে। ছিল না কোনো বড় গাছ। তাহলে কারা কীভাবে এই মূর্তি বানাল? আর কেনই বা এত বড় মূর্তি বানাল? তাছাড়া পরিস্থিতিটা আরও রহস্যাবৃত করেছিল ইস্টারের আদি বাসিন্দারা। তাদের কথা অনুযায়ী, পাথর খোদাই করার পর পুরোহিতরা ‘মানা’ নামে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার বলে মোয়াইকে হেঁটে আহুতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিত এবং তারা চলেও যেত।

map

এছাড়া দ্বীপটির প্রাচীন নাম নেভাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড ও আই’স লুকিং অ্যাট হেভেন অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদের অন্য রকম গবেষণায় নিয়ে যায়। তাদের মতে, দ্বীপটি অনেক আগেই বসবাসযোগ্য ছিল এবং প্রাচীন কোনো উন্নত সভ্যতা যারা পরে হারিয়ে গিয়েছিল তারা দ্বীপটিতে বসবাস করত। কোনো একসময়
এটি পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দু ছিল।

এরিখ ভন দানিকেনসহ কিছু শৌখিন প্রত্নতত্ত্ববিদ এসব কর্মকাণ্ডকে ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের কাজ বলে ঘোষণা
দিয়ে রহস্য আরও বাড়িয়ে তুললেন। তাদের কথা হলো, একদল আটকেপড়া ভিনগ্রহবাসী এসব মূর্তি বানানো শুরু করেছিল, পরে যখন তাদের উদ্ধার করতে আসা হয় তখন মূর্তি নির্মাণ অসমাপ্ত রেখেই তারা চলে যায়।

দ্বীপটির প্রধান মূর্তি তৈরির কারখানা রানু রারাকুতে প্রচুর ব্যাসল্ট পাথরের তৈরি ছেনা, বাটালি পাওয়া
গেছে। পাথর খোদাই করতে হলে আধুনিক যন্ত্র লাগবে এমন কিছু নয়, প্রাচীন এসব যন্ত্রপাতি দিয়েও পাথর খোদাই করা সম্ভব তবে দরকার প্রচুর লোক। কিন্তু এত লোক দ্বীপবাসী পেল কোথায়? যদিও রগেভিন যখন দ্বীপটিতে নামেন তখন খুব বেশি লোক ছিল না।

কিন্তু সাম্প্রতিককালে গবেষণায় দেখা যায় ইস্টার এক সময় গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ ছিল। ছিল প্রচুর পাখির বাস এবং তারা মাছ ধরার নৌকা চালানোতে ছিল পটু। কারণ দ্বীপে মাটি খুঁড়ে ডলফিনের কঙ্কালও পাওয়া গেছে। প্রতিটি মূর্তি আকারভেদে ৫০-১৫০ জন লোকের পাথর কেটে তৈরি করতে খুব বেশি দিন লাগার
কথা নয়। মূর্তিগুলো পরিবহনে ওয়াই আকৃতির স্লেজ নির্মাণ করা হয়েছিল এই পাম দিয়ে। ইস্টারে থাকা হাও-হাও নামক এক ধরনের গাছের ছাল ব্যবহার করা হয়েছে দড়ির কাজে।

মোয়াই’র আকারভেদে ১৮০-২৫০ জন মানুষ টানতে হয়েছে স্লেজ গাড়িকে। তবে সবচেয়ে বড় মোয়াই পারুকে টানতে এর ৫-৬ গুণ বেশি লোক লেগেছে। একসঙ্গে সবাই সমানগতিতে টানলে সবচেয়ে দূরের আহুতেও সর্বোচ্চ সপ্তাহখানেক লেগেছিল। এরপর ধাঁধা হলো আহুতে মূর্তিগুলো কীভাবে স্থাপন করা হলো তা নিয়ে।

এরও ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। প্রথম মোয়াই’র নিচের দিকটা আহুর ঢালু অংশে টেনে তোলা হয়েছিল। তারপর কাঠ দিয়ে মোয়াই’র মাথা আস্তে আস্তে উপরে উঠানো হয়। ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একাধিক মানুষ দড়ি ব্যবহার করত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে কোনো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার না করেই থর হেয়েরডালসহ একাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু মোয়াইকে প্রাচীন উপায়ে আবার আহুতে স্থাপন করেছেন।

মূর্তি বানানোর এই কালচার পলিনেশীয় অন্যান্য দ্বীপেও পাওয়া যায়, তবে এত বড় আকারের নয়। মূর্তিগুলো তাদের পূর্বপুরুষের প্রতিনিধিত্ব করে এবং এগুলো তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও কৃতিত্বের প্রতীক বহন করে। তবে এত বিশাল মূর্তি বানানোর ক্ষেত্রে সম্ভবত প্রতিযোগী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছিল। ইস্টারে ১১টির মতো গোষ্ঠী ছিল যারা হয়তো একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। মূর্তি অসমাপ্ত রাখার কারণ হলো, ততদিনে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যাওয়া এবং এই বিশাল কর্মযজ্ঞ চালাতে গিয়ে দ্বীপের বৃক্ষ ও খাদ্যভাণ্ডার শেষ করে ফেলা।

পরিবেশের বিপর্যয় হওয়ায় ইস্টার দ্বীপে যা হবার তা-ই হলো । খাদ্যাভাব দেখা দিল। সম্পদের অপচয় পুরোদমে চালু ছিল, কিন্তু সেই প্রাকৃতিক সম্পদ নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছিল না। ফলে জনসংখ্যা সাংঘাতিক রকম কমে আসে। গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। একদল সামরিক নেতার আবির্ভাব হয় যারা পুরনোসর্দারদের উৎখাত করে। একইসাথে পুরনো পুরোহিত সম্প্র্রদায় এবং তাদের মূর্তি নিমার্ণও বন্ধ হয়ে যায়। মানুষের সমস্ত রাগ গিয়ে মূর্তির উপর পড়ে। মূর্তি ফেলে ভাঙা শুরু হয়।

মূর্তি এমন এক প্রতীক যা সভ্যতার সৌকর্য- দম্ভ-ক্ষমতা-জৌলুস প্রদর্শন করে। তাই ক্ষুদ্র মানুষ আবার
সেই প্রতীককেই আক্রমণ করে বসে। এ ঘটনা আমরা এ আধুনিককালেও দেখেছি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়ে লেনিনের মূর্তি ভাঙ্গায়, কিংবা রোমানিয়ায় চসেস্কুর মূর্তি ভাঙায়, অথবা ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের মূর্তি ভাঙায়।

এই ঘটনা সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরকরাজার দেশে’ সিনেমায় খুব সুন্দর প্রতীকীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ছবিটির শেষ দৃশ্যে: ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান।’ যেখানে দড়ি ধরে টেনে হীরক রাজার বিরাট মূর্তি উপরে ফেলা হয়। একই রকমে ইস্টার দ্বীপের মানুষেরাও তাদের অন্তর্জালা মিটিয়েছে পুরনো ধর্মীয়
চেতনাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে। এমনকি এক পর্যায়ে তারা নরমাংসও ভক্ষণ শুরু করে। ষোলোশো পঞ্চাশ সালের পরে ইস্টার দ্বীপে মুরগির সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু বর্জ্যস্থানগুলোয় নরাস্থির সংখ্যাও বেড়ে চলে। ইস্টারদ্বীপে প্রচলিত সবচেয়ে জঘন্যতম গালির শাব্দিক অর্থ হলো তোর মায়ের মাংস এখনো আমার দাঁতের ফাঁকে লেগে আছে। এভাবে কয়েকশ বছরের অস্বাভাবিক জঙ্গল নিধন করায় এক সময়ের জঙ্গলাকীর্ণ ইস্টারদ্বীপটি সম্পূর্ণ রিক্ত হয়ে যায়। সেখানে পাল্লা দিয়ে বাড়ে আরো বড় আরো ভারী মূর্তি নির্মাণের প্রতিযোগিতা। দেবতাকে তুষ্ট করে প্রাণ রক্ষার শেষ চেষ্টা যেন-বা।

প্রতিক্ষণ/এডি/এসএবি

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G